হাসপাতালে এএসপি হত্যা

তদন্তে উঠে এসেছে, ঘটনার সময় রোগীর চিকিৎসা দিতে পারেন—এমন কোনো মনোরোগ চিকিৎসক হাসপাতালে ছিলেন না। যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অদক্ষতার কারণে সুচিকিৎসার জন্য সেখানে যাওয়া সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিমকে ‘আদিম মধ্যযুগীয় কায়দায় অমানুষিক নির্যাতন’ করা হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনাস্থলে তিনি মারা যান। এ ছাড়া ঘটনার দিন পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে মাইন্ড এইড হাসপাতাল কোনো ধরনের নিবন্ধন পায়নি।

সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিমকে পিটিয়ে হত্যার মামলায় অনুমোদনহীন এক হাসপাতালের ৭ মালিকসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছিল আদাবর থানা–পুলিশ। তবে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে সেই ‘মাইন্ড এইড’ মানসিক হাসপাতালের চার মালিককে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে আনিসুলকে ওই হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দেওয়া জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের একজন চিকিৎসককেও।

এএসপি আনিসুল হত্যার ঘটনার তদন্ত শেষে গত নভেম্বরের শুরুতে ১০ জনের সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পিবিআই। যদিও মামলার বাদী আনিসুল করিমের বাবা ফাইজুদ্দীন আহম্মেদের ভাষ্য, আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়ার কথা তিনি শুনেছেন। কিন্তু পিবিআই কাদের আসামি করেছে তা জানেন না।

জ্যেষ্ঠ ফৌজদারি আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বলেন, অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করার আগে তদন্তের ফলাফল বাদীকে জানানোর আইনি বাধ্যবাধকতা আছে।

আনিসুল করিম হত্যা মামলা আদালতের নির্দেশে পুনঃ তদন্ত করে পিবিআই। এর আগে আদাবর থানা-পুলিশ এ মামলায় গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ১৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছিল।

এএসপি আনিসুলকে ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর রাজধানীর আদাবর থানা এলাকার মাইন্ড এইড হাসপাতালে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ তুলে খুনের মামলা করেন তাঁর বাবা ফাইজুদ্দীন আহম্মেদ। আনিসুল করিম ৩১তম বিসিএস পরীক্ষায় পুলিশ ক্যাডারে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। তিনি সর্বশেষ বরিশাল মহানগর পুলিশে সহকারী পুলিশ কমিশনার (এএসপি পদমর্যাদা) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়ায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের ৩৩ ব্যাচের ছাত্র ছিলেন আনিসুল করিম।

পিবিআইয়ের তদন্তে উঠে এসেছে, ঘটনার তিন–চার দিন আগে থেকে হঠাৎ করেই এএসপি আনিসুল চুপচাপ হয়ে পড়েন। ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর সকালে স্বজনেরা তাঁকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে নিয়ে যান। এই ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার আবদুল্লাহ আল মামুন তাঁকে (আনিসুল) মাইন্ড এইড হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আনিসুলকে ওই হাসপাতালে নিয়ে যান স্বজনেরা।

মামলার বাদী ফাইজুদ্দীন আহম্মেদ বলেন, পিবিআই তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছে বলে শুনেছেন। তবে এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। তাঁর ভাষ্য, পিবিআই কাদের আসামি করেছে, সেটাও তিনি এখনো জানেন না।

পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবদেন বলা হয়েছে, মাইন্ড এইড হাসপাতালের নিচতলায় আনিসুলের স্বজনেরা তাঁকে ভর্তি করার ফরম পূরণ করছিলেন। এ সময় আনিসুলকে শৌচাগারে নেওয়ার কথা বলে দ্বিতীয় তলার ‘অ্যাগ্রেসিভ রুমের’ (মানসিক রোগীদের জন্য বিশেষ কক্ষ) সামনে নিয়ে যান হাসপাতালের পরিচালক আরিফ মাহমুদ (মালিকদের একজন)। আনিসুল স্বাভাবিকভাবেই হেঁটে যান। আরিফ মাহমুদের সঙ্গে দ্বিতীয় তলায় যান হাসপাতালের সমন্বয়ক রেদুওয়ান সাব্বির (মালিকদের একজন), ফার্মাসিস্ট তানভীর হাসান, কিচেন সেফ (বাবুর্চি) মো. মাসুদ, ওয়ার্ড বয় সজীব চৌধুরী, অসীম চন্দ্র পাল, জোবায়ের হোসেন ও তানিফ মোল্লা। ওয়ার্ড বয় লিটন আহম্মেদ ও সাইফুল ইসলাম আগে থেকেই দোতলায় ছিলেন।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আনিসুলকে দোতলায় বসতে বলা হলে তিনি নিচে নামতে চান। এ সময় আনিসুলের হাত ধরেন আরিফ। হাত সরিয়ে নিতে গেলে তা আরিফের মুখে লাগে। একপর্যায়ে আনিসুল ক্ষিপ্ত হয়ে মাসুদ ও সজীবকে চড় মারেন। পরে আরিফের নির্দেশে আনিসুলকে জোর করে ‘অ্যাগ্রেসিভ রুমে’ নিয়ে যাওয়া হয়। সেই কক্ষের মেঝেতে (ফ্লোর) রাখা ম্যাট্রেসের ওপর আনিসুলকে উপুড় করে ফেলা হয়। আনিসুলের পিঠের ওপর চেপে বসেন মাসুদ ও তানভীর। তানিফের আনা ‘ওড়না’ দিয়ে আনিসুলের দুই হাত পেছন থেকে বেঁধে ফেলেন অসীম। এ কাজে অসীমকে সহায়তা করেন মাসুদ। আনিসুলের ঘাড়ে কনুই দিয়ে আঘাত করেন সজীব। একইভাবে আনিসুলের ঘাড়ে ও মাথায় আঘাত করেন তানিফ। পাশাপাশি আনিসুলের মাথায় চেপে বসেন তিনি (তানিফ)। লিটন ও জোবায়ের আনিসুলের দুই পা চেপে ধরেন। পলাশ আনিসুলের শরীর চেপে ধরেন। কিছুক্ষণ পর আনিসুল নিস্তেজ হয়ে পড়েন। তাঁর (আনিসুল) চেতনা আর ফেরেনি।

বাদী এমন তদন্তই চেয়েছেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত নন, এমন ব্যক্তিকে বাদী আসামি করতে আগ্রহী নন। কারণ, এই হত্যা পরিকল্পিত নয়, ঘটনার আকস্মিকতা। এ কারণে যাঁরা ঘটনাস্থলে ছিলেন, তাঁদেরই আসামি করা হয়েছে।

অব্যাহতি পাওয়া চার মালিকের বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্রে বলেছেন, মালিকদের মধ্যে সাখাওয়াত হোসেন ঘটনার সময় সুইডেনে ছিলেন। আবদুল্লাহ আল মামুন ২০১৭ সাল থেকে ২ নম্বর বড় মগবাজারের আদ-দ্বীন মহিলা মেডিকেল হাসপাতালে কর্মরত। সাজ্জাদ আমিন গাজীপুরের জিএমএস কম্পোজিট নিটিং ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের মার্কেটিং বিভাগে চাকরি করেন। ফাতেমা খাতুন গ্রিন রোডের সেন্ট্রাল হাসপাতালে নার্সিং হাসপাতালে ২০১৬ সাল থেকে কর্মরত। তাঁরা মাইন্ড এইড হাসপাতালে অর্থ বিনিয়োগ করলেও কখনো হাসপাতালে যাননি।

আনিসুলের মাথায় চেপে বসেন তানিফ। লিটন ও জোবায়ের আনিসুলের দুই পা চেপে ধরেন। পলাশ আনিসুলের শরীর চেপে ধরেন। কিছুক্ষণ পর আনিসুল নিস্তেজ হয়ে পড়েন। তাঁর (আনিসুল) চেতনা আর ফেরেনি।

এদিকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার আবদুল্লাহ আল মামুনের বিষয়ে পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, সরল বিশ্বাসে আলোচনাক্রমে আনিসুলকে মাইন্ড এইড হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি।

এএসপি আনিসুল হত্যা মামলা পুনঃ তদন্ত করেছেন পিবিআইয়ের ঢাকা মহানগর উত্তর অঞ্চলের পরিদর্শক এ কে এম নাসির উল্যাহ। গত শুক্রবার রাতে তিনি বলেন, গত নভেম্বরে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন। তিনি যে তদন্ত করেছেন, বাদী এমন তদন্তই চেয়েছেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত নন, এমন ব্যক্তিকে বাদী আসামি করতে আগ্রহী নন। কারণ, এই হত্যা পরিকল্পিত নয়, ঘটনার আকস্মিকতা। এ কারণে যাঁরা ঘটনাস্থলে ছিলেন, তাঁদেরই আসামি করা হয়েছে। কিন্তু থানা-পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রে হাসপাতালের চার মালিককে কেন আসামি করেছে, তারাই বলতে পারবে।

অনুমোদনহীন হাসপাতাল, চিকিৎসায় অদক্ষ জনবল নিয়োগ, রোগী দেখার মতো চিকিৎসক না থাকায় মালিকেরা দায় এড়াতে পারেন কি না, জানতে চাইলে এ কে এম নাসির উল্যাহ বলেন, যে তিনজন হাসপাতালের পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের আসামি করা হয়েছে। চারজন শুধু অংশীদার ছিলেন, পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। এ কারণে তাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার আবদুল্লাহ আল মামুনকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়ে পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, বাদী আগ্রহী নন। আর পিবিআইয়ের তদন্ত একক কোনো ব্যক্তি করেন না। তিনি (রেজিস্ট্রার আবদুল্লাহ আল মামুন) জড়িত না থাকায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেই তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

২০২০ সালের ৯ নভেম্বর রাজধানীর আদাবর থানা এলাকার মাইন্ড এইড হাসপাতালে এএসপি আনিসুলকে নির্যাতন করে হত্যার মামলা করেন তাঁর বাবা ফাইজুদ্দীন আহম্মে।

এদিকে পাঁচ আসামির দায় খুঁজে না পেলেও অভিযোগপত্রে তাঁদের আসামি করা হয়েছে। এ বিষয়ে অভিযোগপত্রে পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তা তাঁর মতামতে উল্লেখ করেছেন, পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে মর্মে পূর্ববর্তী তদন্ত কর্মকর্তা (আদাবর থানার তদন্ত) অভিযোগপত্র দাখিল করলেও তাঁর তদন্তে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। পূর্ববর্তী তদন্ত কর্মকর্তা আগের অভিযোগপত্রে তাঁদের অভিযুক্ত হয়েছে উল্লেখ করার কারণে আইনের বাধ্যবাধকতা থাকায় তাঁদের অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

এই মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা আদাবর থানার তৎকালীন পরিদর্শক ফারুক মোল্লা। তিনি এখন ডেমরা থানায় কর্মরত। ফারুক মোল্লা বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না রেখে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার কারণে হাসপাতালের মালিকেরা দায় এড়াতে পারেন না। এ কারণে তিনি সব মালিককে আসামি করে অভিযোগপত্র দিয়েছিলেন। আর মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের একজন চিকিৎসক সরকারি হাসপাতাল রেখে অনুমোদনহীন হাসপাতালে রোগী পাঠিয়েছিলেন। সরকারি বিধি অনুযায়ী এটা তিনি করতে পারেন না। এ কারণে তাঁকে আসামি করা হয়।

মামলার বাদী এএসপি আনিসুলের বাবা ফাইজুদ্দীন আহম্মেদের সঙ্গে গতকাল শনিবার তিনি বলেন, পিবিআই তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছে বলে শুনেছেন। তবে এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। তাঁর ভাষ্য, পিবিআই কাদের আসামি করেছে, সেটাও তিনি এখনো জানেন না। তবে ছেলে হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করেন তিনি।