ঝালমুড়ি বিক্রি করে মাসিক আয় ৬০ হাজার টাকা
রাজশাহীবাসীর বিনোদনের স্থান মানেই পদ্মাপাড়। প্রতিদিন এ নদীর ধারে হাজার হাজার মানুষের জনসমাগম ঘটে। তবে সাপ্তাহিক ছুটি কিংবা উৎসব আমেজের দিনগুলোতে থাকে উপচে পড়া ভিড়। এ পদ্মাপাড়ে রয়েছে ছোট-বড় অনেক ফাস্টফুডের দোকান।
তবে নদীর পাড়ে ফাস্টফুডের দোকানে সবাই না যেতে পারলেও রাস্তায় বিক্রি হওয়া বাদাম, ভুট্টা, চা, চটপটি, পেয়ারা ও আমড়া মাখানো, ভ্রাম্যমাণ আইসক্রিমসহ ঝালমুড়ির দোকানে সবাই যেতে পারেন। নিতে পারেন অল্প টাকার মুখরোচক সব খাবারের স্বাদ। বিনোদন প্রেমীরা বিনোদনের পাশাপাশি পরিবারের জন্য এসব মুখরোচক খাবার স্বানন্দে কেনেন। যার কারণে অল্প পরিসরে গড়ে ওঠা এসব ছোটখাটো মুখরোচক দোকানেগুলোতে বিকিকিনি হয় বেশ।
রাজশাহী নগরীর দরগাপাড়ার বাসিন্দা তানজিলা (৪২)। লালন শাহ মুক্ত মঞ্চের ঠিক পেছনেই একটি টেবিল পেতে বসেন তিনি। টেবিলে কয়েকটি কন্টেইনার রাখা। তাতে রয়েছে চানাচুর, চিড়াভাজা, কাঁচাছোলা, সেদ্ধছোলাসহ কয়েক কিসিমের ঝালমুড়ি বিক্রির উপাদান। এছাড়াও টেবিলে আছে পেঁয়াজ-মরিচ-ধনিয়াপাতা কুচি রাখার পাত্র এবং স্পেশাল তেলমিশ্রিত মসল্লা। তার হাতের ডানদিকে রয়েছে বিশালাকার প্লাস্টিকের জারভর্তি মুড়ি। এসব দিয়েই তানজিলা প্রতিদিন বিক্রি করেন ঝালমুড়ি। আর এ মুড়ি বেচেই তার মাসিক আয় প্রায় ৬০ হাজার টাকা।
তিনি জানান, একটা সময় বহু কষ্টে কেটেছে তার সংসার জীবন। স্বামীর স্বল্প উপার্জনে সংসারে ছিল দৈন্যদশা। তাই নিজ উদ্যোগে সংসারের হাল ধরতে পদ্মাপাড়ে ঝালমুড়ির একটি ছোট দোকান নিয়ে নেমে পড়েন ব্যবসায়। প্রথমদিকে ডালভাত খাওয়ার মতো পয়সা জুটলেও বর্তমানে প্রতি মাসে ঝালমুড়ি বেঁচেই তানজিলার আয় হয় ৬০ হাজার টাকা।
তিনি জানান, তিন ছেলে মেয়ের মধ্যে ছেলেকে ছোট থাকতেই হারিয়েছেন। এখন রয়েছে দুই মেয়ে। বহুকষ্টে তাদের মানুষ করে বিয়ে দিয়েছেন। এখন স্বামী-স্ত্রী মিলে যা কামান তাতেই কেটে যায় বেশ।
জীবন সংগ্রামী এ নারী বলেন, করোনা আসার আগে নিজ এলাকায় ছাত্রদের মেসে রান্নাবান্নার কাজ করতাম। মোটামুটি চলতো চারজনের পেট। কিন্তু করোনাভাইরাস ও টানা লকডাউনে বন্ধ হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এতে ছাত্ররা মেস ছেড়ে চলে যাওয়ায় কর্মহীন হয়ে পড়ি, বন্ধ হয়ে যায় আমার উপার্জন। এমনকি আমার স্বামীর উপার্জনও ছিল বন্ধ। আমাদের সংসারে নেমে আসে চরম বিপর্যয়।
তিনি বলেন, তবে হার মানিনি। করোনার মধ্যেও বাঁধের ওপর মুক্তমঞ্চের গেটের সামনেই দিয়েছিলাম স্বল্প পরিসরে ঝালমুড়ির দোকান। কিন্তু বাধ সাধে লকডাউন, পুলিশ ও প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা। তারপরও বিকেলের দিকে আশপাশের কিছু মানুষজন নদীর ধারে বেড়াতে আসতো। তাতেই আমিসহ অনেকেই টুকটাক বেচাকেনা করে চালাতাম নিজেদের পেট।
লকডাউনের শুরুর দিকে একদিন ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ এসেছিলো আমার দোকানে। তখন কাগজের প্যাকেটে ঝালমুড়ি বিক্রি করতাম। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে কোনো প্রকারের জরিমানা না করে পরামর্শ দিলেন- ‘করোনার মধ্যে কাগজের ব্যবহার না করে ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের গ্লাস এবং প্লাস্টিকের চামচে বিক্রি করুন। তাতে আপনার ঝালমুড়ি যেমন স্বাস্থ্যকর দেখাবে, তেমনি আপনার বিক্রিও ভালো হবে।’
তারপর থেকে আজ অবধি ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের গ্লাস ও চামচ দিয়ে ক্রেতাদের ঝালমুড়ি দিই। একটি ওয়ানটাইম গ্লাস ও চামচে খরচ হয় দেড় টাকা করে।
তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন প্রায় হাজার, দেড় হাজার করে গ্লাস-চামচ কেনা হয়। প্রথমে খরচের দিকটা ভেবে খারাপ লাগতো। কিন্তু প্লাস্টিকের গ্লাসে ঝালমুড়ি সুন্দর দেখানোর কারণে আমার বিক্রিও প্রচুর বেড়ে যায়, তাই এটা নিয়ে আর খারাপ লাগে না। দু’বছরের ব্যবধানে আমার এখন ধরাবাঁধা প্রায় শত-শত কাস্টোমার। যারা লালন শাহ মুক্তমঞ্চের পদ্মাপাড়ে এলেই আমার ঝালমুড়ি কেনেন।
তানজিলার স্বামী রুমন বলেন, সকালে আমি ঝালমুড়ির প্রয়োজনীয় উপাদান বাজার থেকে কিনে আনি। তারপর সকাল বা দুপুরের দিকে সে (তানজিলা) পেঁয়াজ, মরিচ, ধনিয়াপাতা, ছোলা এবং মসলাসহ অন্যান্য জিনিসপত্র তৈরি করে। বিকেল ৪টা থেকে ৫টার দিকে এসে ব্যবসা শুরু করা হয়। তানজিলা ঝালমুড়ি বানায় আর আমি পাশে থেকে অন্যান্য কাজে তাকে সহযোগিতা করি। বিকেল থেকে একেবারে রাত নয়টা পর্যন্ত ব্যবসা করার পর দোকান বন্ধ করে দিই।
আয়-ব্যয়ের হিসাব জানতে চাইলে তারা জানান, সারাদিনে প্রায় পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকার ঝালমুড়ি বিক্রি হয়। প্রতিদিন গড়ে চার হাজার টাকার মতো বিক্রি হয়। এতে লাভ থাকে প্রায় হাজার দুয়েক টাকা। তবে শুক্রবার ছুটির দিন কিংবা বিশেষ দিনে দশ বারো হাজার টাকারও ঝালমুড়ি বিক্রি হয় বলে জানান তানজিলা ও তার স্বামী।