পরিস্থিতির অবনতির দিকে
এক দিনে সবচেয়ে বেশি মানুষের (৬৬ জন) মৃত্যু হয়েছে গতকাল মঙ্গলবার। আর সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ৭ হাজার ২১৩ জনের। এটিও গত ১৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে গত সোমবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য দেশজুড়ে একধরনের লকডাউন চলছে। সরকারি বিধিনিষেধের দ্বিতীয় দিনেই দেশে মৃত্যু ও শনাক্তের ক্ষেত্রে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
সিডিসি তাদের ওয়েবসাইটে দেওয়া সতর্কবার্তায় বলেছে, বাংলাদেশের এখনকার পরিস্থিতি এমন যে টিকা নেওয়া কোনো ব্যক্তিও সেখানে ভ্রমণ করে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবেন। যদি বাংলাদেশে ভ্রমণ করতেই হয়, ভ্রমণের আগে টিকার সব ডোজ নিতে হবে, অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে এবং অন্যদের থেকে ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
সিডিসি চতুর্থ স্তর নির্ধারণ করে সর্বশেষ ২৮ দিনের সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে। ২ লাখের বেশি জনসংখ্যা রয়েছে এমন অঞ্চল বা দেশের ক্ষেত্রে ২৮ দিনের মোট আক্রান্তের হার যদি প্রতি ১ লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে ১০০ জনের বেশি হয়, তাহলে সেটি চতুর্থ স্তরে পড়ে।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ২৮ দিনে বাংলাদেশে প্রায় ১ লাখ নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। প্রতি ১ লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে আক্রান্তের হার ৬০০-এর বেশি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা আছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চলমান ঢিলেঢালা বিধিনিষেধ কতটা প্রভাব ফেলবে, তা বোঝা যাবে আরও দুই সপ্তাহ পর। এর আগ পর্যন্ত অন্তত দুই সপ্তাহ সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকতে পারে। একইভাবে সামনের তিন সপ্তাহে মৃত্যু আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দেশে দীর্ঘদিন পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকার পর গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা দেয়। এরপর মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে দ্রুত সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। এমন পরিস্থিতিতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হলেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে মানুষের মধ্যে যেমন উদাসীনতা রয়েছে, তেমনি স্বাস্থ্যবিধি মানাতে সরকারি জোর চেষ্টাও সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। আবার বিধিনিষেধ তুলে নিতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ হচ্ছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরামর্শক মুশতাক হোসেন বলেন, দেশ এখন একটি নাজুক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সংক্রমণে ক্রম ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে। এটা প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে অনেক বেশি খাড়া। আগামী দুই সপ্তাহ নতুন রোগী বৃদ্ধির প্রবণতা অব্যাহত থাকার আশঙ্কা আছে। তিনি বলেন, এখন যাঁদের মৃত্যু হচ্ছে, তাঁদের বেশির ভাগ তিন সপ্তাহ আগে সংক্রমিত হয়েছিলেন। কার্যকর চিকিৎসা না হলে রোগীর সঙ্গে আনুপাতিক হারে মৃত্যুও বাড়বে।
এই রোগতত্ত্ববিদ বলেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে লকডাউন একটি কার্যকর ব্যবস্থা। কিন্তু এতে প্রান্তিক মানুষের খুব সমস্যা হচ্ছে। এখন দুই দিকেই বিপদ। উভয় দিক সমন্বয় করে ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু লকডাউন দিলেই হবে না। রোগীদের আইসোলেশনে (বিচ্ছিন্ন করা) নেওয়া, তাঁদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ) করা, টিকাদান দ্রুত আরও সম্প্রসারণ—এসবে জোর দিতে হবে।
বিশ্বের যেসব দেশে এখন আবার করোনা রোগী দ্রুত বাড়ছে, তার একটি বাংলাদেশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, (সোমবার পর্যন্ত হালনাগাদ) সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬তম।
দেশে সংক্রমণের প্রথম ঢেউ যখন চূড়ায় ছিল, তখন প্রতিদিন ১৪ থেকে ১৮ হাজার মানুষের নমুনা পরীক্ষা হতো। এখন ২৫ থেকে ৩০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ার কারণেই শুধু নতুন রোগী বাড়ছে। কেননা পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হারও এখন ২০ শতাংশের ওপরে। গত বছরের মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত শনাক্তের হার ২০ শতাংশের ওপরে ছিল। এরপর থেকে তা ছিল নিম্নমুখী।
গত এক সপ্তাহ শনাক্তের হার আবার ২০ শতাংশের ওপরে। এই হার বলছে, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ থেকে বাংলাদেশ অনেক দূরে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঠিক করা মানদণ্ড অনুযায়ী, কোনো দেশে রোগী শনাক্তের হার টানা দুই সপ্তাহের বেশি ৫ শতাংশের নিচে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরা যায়।