দেশেই চলছে ব্রাজিল–আর্জেন্টিনার খেলা
দুই মৌসুম ধরে মোটাদাগে বসুন্ধরা কিংসকে এই প্রচলিত ছকের বাইরেও যেতে দেখা যায়নি তেমন। দেখা গেল না গতকালও। ৪-৩-৩ ছকের ঝান্ডা উঁচিয়েই গতকাল রহমতগঞ্জকে ৩-০ গোলে হারিয়ে ফেডারেশন কাপে শুভসূচনা করেছে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরা কিংস।
বসুন্ধরার দলটা এবার পুরোপুরি লাতিন ছন্দে মেতে ওঠার পরিকল্পনাই করেছে। সে ছন্দ এই ম্যাচে যে পুরোদমে দেখা গেছে, বলা যাবে না। ম্যাচ শেষে কোচের বয়ানেই তার প্রতিফলন ঘটেছে। কিন্তু যা দেখা গেল, তাই–বা কম কী? কথায় বলে, একটা ফুটবল দলের চ্যাম্পিয়ন হয়ে ওঠার পেছনে এমন কিছু খেলোয়াড় দরকার, যাঁরা দলের মেরুদণ্ডটা গড়ে দিতে পারেন।
বাকিদের মধ্যে অদলবদল হচ্ছে হোক, ওই কজন খেলোয়াড়কে থাকতে হয় নিয়মিত। এবার দুই ব্রাজিলিয়ান রবসন ডি সিলভা ও জোনাথান ফার্নান্দেস, ওদিকে আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার রাউল বেসেরাকে দিয়ে সে মেরুদণ্ড গড়ে তোলার চেষ্টায় আছে বসুন্ধরা কিংস। ম্যাচের আগে সন্দেহ ছিল, গত মৌসুমের দানিয়েল কলিনদ্রেস, মার্কোস ভিনিসিউস কিংবা হার্নান বার্কোসের মতো প্রভাব দেখিয়ে খেলার মতো যোগ্যতা আছে তো তাঁদের? তিনজন সে সন্দেহটাকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য সময় নিলেন মোটে এক ম্যাচ।
জোনাথান ফার্নান্দেসকে দিয়ে শুরু করা যাক। ৪-৩-৩ ছকে মাঝমাঠের তিনজনের মধ্যে একপাশে খেলেছেন এই তারকা। পায়ে লাতিন কারুকাজ তো ছিলই, সঙ্গে আদর্শ বক্স-টু-বক্স মিডফিল্ডারের মতো ক্রমাগত ওপর-নিচে ওঠানামা করতেও সমস্যা হয়নি তাঁর। ঠিক যেন হার না-মানা সেই ইঞ্জিন, যিনি ক্রমাগত বেসেরা-রবসন ও মতিনকে লাইসেন্স দিচ্ছিলেন আক্রমণে মনোযোগ দেওয়ার। সঙ্গে নিখুঁত সেটপিস নেওয়ার ক্ষমতা তো আছেই। জোনাথানের সেটপিস থেকেই গোলের মুখ খোলে বসুন্ধরা। তাঁর মাঝমাঠ থেকে নেওয়া এক ফ্রি-কিক থেকেই ডি-বক্সে হেড করে দলকে এগিয়ে দেন রাউল বেসেরা। স্ট্রাইকাররা যদি একটু লম্বা-চওড়া হন, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই ডি-বক্সের ডিফেন্ডারদের সঙ্গে কসরতের খেলায় জেতার সম্ভাবনাটা একটু বেশিই থাকে। সেটাই দেখিয়েছেন এই স্ট্রাইকার।
মাঝে মাসুক মিয়া জনিকে রেখে এক পাশে জোনাথান খেললে, আরেক পাশে ছিলেন আরেক ব্রাজিলিয়ান রবসন। এখন এভারটনে খেলা ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার রিচার্লিসন যখন ব্রাজিলের ক্লাব ফ্লুমিনেন্স ছাড়লেন, তখন তাঁর বিকল্প হিসেবে এই রবসনের দিকেই হাত বাড়িয়েছিল ব্রাজিলের ক্লাবটা। কেন বাড়িয়েছিল, সেটার প্রমাণ ফ্লুমিনেন্সে না দেখাতে পারলেও ঢাকায় প্রথম সুযোগেই দেখালেন। মাঝমাঠে খেললেও স্বদেশি জোনাথানের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি আক্রমণাত্মক ছিলেন। নিজের ১০ নম্বর জার্সিটার মান রাখতেই কি না, বিশ্বের অধিকাংশ ১০ নম্বরের মতো অনেকটা ফ্রি-রোলে খেলেছেন। কি মাঝমাঠ, কি উইং—দাপিয়ে বেড়িয়েছেন সমানে। রহমতগঞ্জের উইংব্যাক মাহমুদুল হাসানের ভুলে পেয়েছেন ঢাকার মাটিতে প্রথম গোল।
আর কী দুর্দান্তভাবেই না সে গোলটা করেছেন! দেশীয় ফুটবলের অতি উৎসাহী কোনো সমর্থক যদি সে গোলের সঙ্গে ইতালিয়ান কিংবদন্তি স্ট্রাইকার ফ্রান্সেসকো টট্টির চিপ করে করা গোলগুলোর সাদৃশ্য খুঁজে পান, খুব বেশি ভুল বলা যাবে না। নিজের প্রাণপ্রিয় ক্লাব এএস রোমার হয়ে অমন গোল টট্টি অহরহ করতেন।
তৃতীয় গোলেও দর্শক দেখেছে রবসন–জাদু। বাঁ প্রান্তের একদম সাইডলাইনে সেই মাহমুদুলকে চ্যালেঞ্জে পরাস্ত করে ডি-বক্সে সুযোগসন্ধানী ক্রস পাঠিয়েছিলেন এই ব্রাজিলিয়ান। দলকে বিপদমুক্ত করতে গিয়ে উল্টো আত্মঘাতী গোল দিয়ে বসেন রহমতগঞ্জের মিসরীয় সেন্টারব্যাক আলায়েলদিন নাসর। গোটা ম্যাচে রহমতগঞ্জ এই এক বিদেশি নিয়েই খেলতে পেরেছে। আগে আবাহনীতে খেলা এই সেন্টারব্যাক অবশ্য এই ম্যাচে নিজের জাত তেমনটা চেনাতে পারেননি, ক্রমশ খাবি খেয়েছেন বসুন্ধরার লাতিন–জাদুতে।
তিন বিদেশির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদেরও খেলতে হবে—এই প্রতিজ্ঞা নিয়েই যেন মাঠে নেমেছিলেন দুই উইঙ্গার মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও মতিন মিয়া। অবশ্য মতিন মিয়া মূল একাদশে থাকবে কি না, সেটা নিয়ে কিঞ্চিৎ ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছিল ম্যাচের শুরুতে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বসুন্ধরা ঘোষণা দিয়ে দিয়েছিল, মতিন নয়, খেলছেন বিপলু আহমেদ। মাঠে দেখা যায় বিপলু নয়, নেমেছেন মতিনই।
এই মতিনই দুই দেশি উইঙ্গারের মধ্যে বেশ খেটে খেলেছেন, ঝলক দেখিয়েছেন। রাইটব্যাক বিশ্বনাথকে মাঝেমধ্যেই ওভারল্যাপ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। ওদিকে ইব্রাহিমকে নিয়ে অবশ্য সে কথা বলা যাবে না। ইব্রাহিল ছিলেন নিজের ছায়া হয়েই। ফর্মে ফেরার জন্য ম্যাচের মধ্যেই উইং পরিবর্তন করেছেন বারবার, লাভ হয়নি। দ্বিতীয়ার্ধে বরং মাহবুবুর রহমান সুফিল নেমেই আক্রমণভাগের শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন আরও বেশি।
ব্রুজোনের এই আক্রমণাত্মক ছকের বদলে খর্ব শক্তির রহমতগঞ্জের কৌশল ছিল মূলত প্রতি–আক্রমণনির্ভর। কিন্তু নিজেদের বাকি বিদেশি খেলোয়াড় না থাকার কারণে সে পরিকল্পনায় বেশ বাজেভাবেই আঘাত এসেছে। তা সত্ত্বেও নজর কেড়েছে সাজিদুর রহমান, সানোয়ার হোসেনদের খেলা। ম্যাচ চলাকালেই রহমতগঞ্জের ফেসবুক পেজের কল্যাণে জানা গেছে, দুই বিদেশি খুরশিদ বেকনাজারভ ও দিলশোদ ভাসিয়েভ পা রেখেছেন বাংলাদেশে। তাঁরা মূল একাদশে আসলে যদি এখন দলটার চেহারা ফেরে একটু!
ব্রুজোন ম্যাচ শেষে জানিয়েছেন, কোনো বিদেশিই পুরো ফর্মে নেই, বেসেরার পূর্ণ ফিটনেসই নেই। তাহলে একবার ভেবে দেখুন, তিন বিদেশির রসায়নটা জমে গেলে কী অবস্থা হবে প্রতিপক্ষদের!