চাকরির আবেদনের বয়স বাড়িয়ে ৩৫ করা কতটুকু যৌতিক?

করোনা মহামারির কারণে অর্থনীতির প্রায় সব সেক্টরই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।গোটা বিশ্ব করোনাভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে মরিয়া।কোনো সেক্টর করোনাভাইরাসের খপ্পর থেকে রক্ষা পায়নি।কোভিড-১৯ আমাদের শিখিয়েছে নতুন মাত্রায় বেঁচে থাকতে । সবাই কমবেশি সংক্রমিত হয়েছে এবং সব জায়গায় এর বিস্তার ঘটছে।বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি দীর্ঘ দিনের। তবে সেই দাবি করোনার সময় আরও প্রকট রূপ ধারণ করছে। আমরা শিক্ষিত জনগণ এই যৌতিক দাবিকে সর্বদাই সমর্থন করি।
কভিড-১৯ মহামারি চাকরিপ্রার্থীদের জীবনেও কালো মেঘের ছায়া পড়ছে।সরকারি ও বেসরকারি খাতে মানবসম্পদের চাহিদা থাকলেও নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে পারছেনা।গত মার্চ থেকে মে পর্যন্ত প্রায় কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়নি। তবে বর্তমানে কিছু চাকরির বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে, যা চাকরিপ্রার্থীদের মনে এখন একটু আশা তৈরি করছে।এডিবির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার কারণে অনলাইন পোর্টাল বিডিজবসে চাকরির বিজ্ঞাপনের সংখ্যা প্রায় ৯০% কমেছে।
ইউজিসির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ৪০টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭ লাখ এবং১৪৬।বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ এখনো নিয়ন্ত্রণে নেই বরং অবনতি হয়েছে। অর্থনীতিকে গতিময় করার জন্য দুই সপ্তাহ লকডাউন শেষে প্রায় সবকিছুই স্বাভাবিক হলেও সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিয়োগ কার্যক্রম শুরু করার জন্য সরকারিভাবে কাজ শুরু করার নির্দেশনা দেওয়া আছে।অনেক সংস্থা গত আগস্ট থেকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করছে। ফলে চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে থাকা কালো মেঘটি কাটা শুরু করছে।আশা করা যায় আগামী কয়েক মাসের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। শুনা যাচ্ছে শিগগিরই সাড়ে চার লাখ শূন্য সরকারি পদ পূরণ করা হবে।হবে। কোভিড-১৯–এর কারণে বেসরকারি খাতে চাকরির সুযোগ সীমাবদ্ধ থাকায় প্রধানমন্ত্রী সরকারি প্রতিষ্ঠানে শূন্যপদ পূরণ করে কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিভাগগুলো ইতিমধ্যে নির্দেশ পাওয়ার পর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তবে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে (পিএসসি) দ্রুত নিয়োগ প্রক্রিয়া সহজ করতে সক্ষম হতে হবে।
আশা করা যায়, নতুন প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ প্রক্রিয়াটিকে আরও সহজ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে।কিন্তু নতুন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও চাকরিপ্রার্থীদের দীর্ঘমেয়াদি আবেদনের বয়স বাড়ানোর কোনো সিদ্ধান্ত দেখা যাচ্ছেনা যা খুবই হতাশাজনক। যদিও বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও বাস্তবিকভাবে কোনো অগ্রগতি নেই। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ বছর করার জন্য দাবি করে আসছেন। উল্লেখ্য এই দাবি মূলত একটি ছাত্রসংগঠন করেছিল ও মানববন্ধনও করেছিল। তাদের একটি প্রতিনিধিদল চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ বছর বাড়িয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে এর যুক্তি উপস্থাপনের দাবি জানিয়েছিল। তখন অনেক নেতাই বলেছিলেন যে তাঁদের দাবিগুলো যুক্তিসংগত এবং চাকরির জন্য আবেদনের বয়সসীমা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ানো হবে। আমরা সাধারণ নাগরিকেরা দাবি প্রাসঙ্গিক এবং যৌক্তিক বলে মনে করি।করোনোভাইরাসের কারণে কোনো চাকরির বিজ্ঞপ্তি ছিল না এবং চাকরিপ্রার্থীরা আবেদনের শেষ বয়সে পৌঁছেছেন। এখানে কেবল তাঁদের সম্পর্কে কথা হচ্ছে না। কোভিড-১৯ ছাত্রছাত্রীদের একাডেমিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। উচ্চমাধ্যমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষার্থীর শিক্ষার জীবন দীর্ঘায়িত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। আমি মনে করি, এটি তাঁদের জীবনে জটিলতা সৃষ্টি হবে। তবে সরকার চাকরিপ্রার্থীদের ৫ মাস বা তার বেশি বয়সে ছাড় দিচ্ছে। অন্য কথায়, সরকার গত বছরের ২৫ মার্চ যাঁদের ৩০ বছর বয়স পূর্ণ করেছে, তাঁদের করোনার সংকটের সময় সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করার অনুমতি দেওয়া হবে। ৩০ বছর বয়সের খুব কাছাকাছি থাকা সরকারি চাকরিপ্রার্থীদের জন্য এটি সুসংবাদ। এটি একটি অত্যন্ত সময়োচিত সিদ্ধান্ত এবং আমি এর জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাই।
তবে আমি মনে করি না এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হবে, কারণ যে শিক্ষার্থীর ২৫ বছরের মধ্যে তাঁর স্নাতক পড়াশোনা শেষ করার কথা বলেন, তিনি কোভিড-১৯–এর কারণে সেটি সম্ভব হবে না। তাঁদের পড়াশোনা শেষ হতে এক বা দুই বছরের বেশি সময় লাগবে। সুতরাং মহামারির সময়কালকে একটি রূপান্তরকাল হিসেবে বিবেচনা করা উচিত এবং সরকারি চাকরির আবেদনের বয়স বাড়িয়ে ৩৫ করা উচিত। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরিপ্রার্থীদের জন্য ৩৮ করা উচিত। শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয়তার কারণে, আমি মনে করি এটি একটি সময়োচিত সিদ্ধান্ত হবে।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ছিল ২৭ বছর। তার পূর্বে ছিল ২৫ বছর। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৯১ সালে বয়সসীমা করা হয় ৩০ বছর। কিন্তু সরকার মনে করেছিল চাকরিতে এন্ট্রি পোস্টে আবেদনের বয়স ৩২ থেকে ৩৫ করা উচিত এবং অবসরের বয়স ৬০ থেকে ৬২ করার বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত ছিল বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু সেটা এখনো বাস্তবে কার্যকর হয়নি। এ নিয়ে এখন আর কোনো কথা হচ্ছে না।
উল্লেখ্য, অনেক দেশে কর্মসংস্থানে প্রবেশের পরিমাণ ৫৫ বছর পর্যন্ত, এমনকি কোথাও ৫৯ বছর পর্যন্ত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৪০; শ্রীলঙ্কায় ৪৫, ইন্দোনেশিয়ায় ৩৫, ইতালিতে ৩৫ ও ফ্রান্সে ৪০। অনেক দেশে আগ্রহী ব্যক্তিরা অবসর নেওয়ার ঠিক আগের দিনই সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে পারেন। তবে আমরা পারব না কেন? আমি আশা করি শিক্ষা এবং ছাত্রবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সালে এই বিষয়টি বাস্তবায়ন করবেন।আবেদনকারীদের মধ্যে এটা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। তাঁরা চাচ্ছেন সরকার এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাঁদের মনের আশা বাস্তবায়ন করুক। করোনার সময় দুই দফায় কিছুটা বয়সের ছাড় দেওয়া হলেও তা সাময়িক।
আমি মনে করি সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ সাধারণ বয়সসীমা ৩৫ বছর এবং মুক্তিযোদ্ধা, চিকিৎসক আর বিশেষ কোটার ক্ষেত্রে এই বয়সসীমা ৩৮ বছর করলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি খুশি হতো। সরকারি ছাড়াও আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানেও একই বয়সসীমা অনুসরণ করা হয়। আর চাকরি থেকে অবসরের সাধারণ বয়সসীমা ৫৯ বছরকরা হোক। যেহেতু বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে, তাই চাকরিতে প্রবেশ এবং অবসরের বয়স বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

লেখক: সাবেক সভাপতি-শিক্ষক সমিতি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ,ত্রিশাল,ময়মনসিংহ।