কেন স্থির ধ্রুবতারা?

ধ্রুবতারার কথা আমরা সকলে জানি। গান, কবিতা, গল্প কিংবা উপন্যাসে সূর্যের পর আকাশের নক্ষত্রের মধ্যে সবচেয়ে বহুল পরিচিত নক্ষত্র হল ধ্রুবতারা।

ধ্রুব অর্থ হল নিশ্চল, স্থির, শাশ্বত, ইত্যাদি। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় পোল স্টার, পোলার স্টার বা পোলারিশ। ল্যাটিনে একে ডাকা হয় লোদোস্তার, যার অর্থ হল সংকেত তারা। এছাড়া ধ্রুবতারা গাইডিং স্টার, নর্থ স্টার নামেও বেশ পরিচিত।

সেই প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের কাছে পৃথিবীর আকাশে দৃশ্যমান তারাদের মধ্যে সবচেয়ে রহস্যময় হল, ধ্রুবতারা। পৃথিবীর আকাশে যেকোনো গ্রহ, নক্ষত্র, ধূমকেতু দেখা যাক না কেন, সে তার স্থান পরিবর্তন করবেই। কারণ পৃথিবী ঘূর্ণনশীল এবং মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুই ঘূর্ণনশীল। সে কারণে পৃথিবীর আকাশে যা-ই দেখা যাক না কেন তার উদয় এবং অস্ত আছে।

একমাত্র ব্যতিক্রম হল ধ্রুবতারা। একে পৃথিবীর আকাশে নিশ্চলরূপে দেখা যায়। পৃথিবীর আকাশে সে কখনোই তার স্থান বদল করেনা। যে কারণে প্রাচীনকালে নাবিকগণ এই তারা দেখে দিক নির্ণয় করতো। আর এসব বিবেচনায় প্রশ্ন আসতেই পারে, তাহলে কি ধ্রুবতারা ঘোরে না? আর না ঘুরলে তার রহস্য কি?

আসলে মহাবিশ্বের সকল বস্তু ঘুরতে বাধ্য। মহাবিশ্বে নিশ্চল রয়েছে এমন কিছুর অস্তিত্ব নেই। সবকিছুর মতো ঘুরছে ধ্রুবতারাও। কিন্তু এই তারাটি পৃথিবীর অক্ষের ওপর এর ঘূর্ণনের সঙ্গে একই গতিতে সামাঞ্জস্যপূর্ণভাবে আবর্তিত হয়। যে কারণে আপাত দৃষ্টিতে পৃথিবী থেকে ধ্রুবতারাকে মনে হয় নিশ্চল। এ কারণেই মনে হয় ধ্রুবতারার উদয় নেই, অস্ত নেই, গতি নেই।

পৃথিবীর সবদেশ থেকেই একমাত্র ধ্রুবতারাকে সারাবছরই আকাশের উত্তরে নির্দিষ্ট স্থানে দেখা যায়। আর এই তারাকে চিনতে পারলেই উত্তর দিকের সন্ধান পাওয়া যায়, যা থেকে অন্য সকল দিকের সন্ধান পাওয়া যায়।

আমাদের বাংলাদেশের আকাশে ধ্রুবতারাকে বেশি উঁচুতে দেখা যায় না। ঢাকা থেকে ধ্রুব তারার উচ্চতা ২৩ ডিগ্রি ৪৩ মিনিট। দিগ্বলয় থেকে আকাশের প্রায় চারভাগের একভাগ উঁচুতেই এই তারাটির মতো উজ্জ্বল আর কোনো তারা নেই বলে একে চিনতে বিশেষ অসুবিধা হয় না। তবে বাংলাদেশ থেকে যতই উত্তরে যাওয়া যাবে, ধ্রুবতারা ততই ওপরে দেখা যাবে।

ধ্রুবতারাকে চিনতে গেলে প্রথমে সপ্তর্ষি মণ্ডল চেনা দরকার। মার্চ এপ্রিল মাসে আকাশের উত্তর-পূর্ব দিকে দ্বিতীয় শ্রেণীর সাতটি তারা এবং আশেপাশের আরো কয়েকটি তারা নিয়ে গ্রীকরা একটি বিরাট ভাল্লুকের কল্পনা করে থাকে। যে কারণে একে তারা ডাকতো বৃহৎ ভাল্লুক মন্ডল বা ‘উরসা মেজর’। হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্রে এখানে একটি ময়ুরের কল্পনা করা হয় এবং এই সাতটি তারাকে সাতটি ঋষি মনে করা হয়, যে কারণে আমাদের ভাষায় একে সপ্তর্ষি মণ্ডল বলা হয়। আমেরিকাতে এই সাতটি তারা দিয়ে একটি হাতলওয়ালা চারকোণা পেয়ালার কল্পনা করা হয় এবং এই মন্ডলটি সে দেশে ‘গ্রেট ডাইপার’ নামে পরিচিত। কোনো কোনো দেশে এই সাতটি তারা দিয়ে একটি লাঙ্গলের কল্পনা করা হয়।

যা হোক, এই সাতটি তারা দিয়ে আকাশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তারকামন্ডল এবং ধ্রুবতারা পাওয়া যায়। সাতটি তারা দিয়ে যে হাতাওয়ালা পেয়ালা কল্পনা করা হয় সেই পেয়ালার হাতলের উল্টোদিকে যে দুটো তারা পাওয়া যায় সেই দুটো তারার উত্তর দিকে ওপরের তারাটি হল ধ্রুবতারা। এই দুটো তারার দূরত্ব হল ৫ ডিগ্রি করে। আর সেখান থেকে ধ্রুবতারার দূরত্ব হল ৩০ ডিগ্রি।

এছাড়া পেয়ালার হাতলের তিনটি তারা যে বৃত্তচাপ গঠন করে সেই বৃত্তচাপটিকে পাঁচগুণ বাড়িয়ে দিলে বুটিস মন্ডলের প্রথম তারাটি পাওয়া যায়। এই উজ্জ্বল তারাটি আমাদের দেশে স্বাতী নক্ষত্র নামে পরিচিত। এছাড়া পেয়ালার হাতলের সোজাসুজি নিচের দিকে আসলে যে উজ্জ্বল তারাটি পাওয়া যায় সেটি হল সিংহ রাশির প্রধান তারা মঘা নক্ষত্র।

জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ধারণা, পৃথিবীর প্রথম থেকে একটি তারকাই কখনো ধ্রুবতারা রূপে বিরাজ করেনা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন তারা উত্তর মেরুর নিকটে থেকে ধ্রুবতারা রূপে বিরাজ করেছে। এবং এই তারাগুলো প্রায় ২৬০০০ বছরের জন্য একটি বৃত্তাকার গতিপথে ভ্রমণ করার সময় পৃথিবী থেকে দৃশ্যমান হয়।

তবে ধ্রুবতারার ইতিহাস এখনো সেভাবে সঠিকরূপে কেউ নির্ণয় করতে পারেনি। কোনো সভ্যতার ইতিহাস থেকেও তেমন কোনো সংকেত মেলেনি, যে কারণে এখনো পর্যন্ত ধ্রুবতারার নিশ্চলতার কারণ আবিষ্কৃত হলেও এর ইতিহাস সম্পর্কে তেমন নির্দিষ্ট করে কিছু বলা কঠিন।