পাগলি মা এর সন্তান
জানা যায়, ওই এলাকায় এক মানসিক ভারসাম্যহীন (পাগলি) নারী থাকতেন। এক সময় তিনি গর্ভবতী হয়ে পড়েন। কিছুদিন পর ফুটফুটে এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। সন্তান প্রসবের কিছুদিন পর এলাকা ছেড়ে চলে যান তিনি। এরপর থেকে স্থানীয় আরেক ভিক্ষুক জোসেদা বিবি শিশুটিকে লালন পালন করছেন।নাম রাখেন আব্দুল্লাহ।
পাগলির গর্ভে জন্ম নেয়া আব্দুল্লাহর প্রতি সমাজের অভিজাত শ্রেণির কোনো কৃপাদৃষ্টি পড়েনি। ফলে সে এখন রাস্তার টোকাই। তবে অভাগা শিশুটির ঠাঁই হয়েছে আরেক অভাগীর ঘরে। ভৈরবা বাজারের পূর্ব দিকে সরকারের এক টুকরো খাস জমিতে টিনের তৈরি ঝুপড়ি ঘরে। এই ঝুপড়ি ঘরের মালিক জোসেদা নামের এক ভিক্ষুক।
বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া পালিত মাই কোনো রকমে আব্দুল্লাহর মুখে দু’মুঠো ভাতের জোগান দিচ্ছেন। চরম অর্থকষ্ট আর অভাব অনটনের মধ্যেও টাকার কাছে বিক্রি হননি এই মা।
এদিকে জেলার সবথেকে বেশি পথশিশুর বসবাস ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ পৌরসভাধীন মোবারকগঞ্জ রেলস্টেশনে। এখানে প্রায় অর্ধশত পথশিশু রয়েছে। যাদের মধ্যে অনন্ত ১৫ জনের বাবা-মা নেই। জন্মের পর বিভিন্ন সময় তারা সন্তানকে ফেলে চলে গেছেন। এরা অন্যের দেয়া খাবার খেয়ে পথে পথে বেড়ে উঠছে।
এদেরই একজন সোহাগ। বয়স ছয় থেকে সাত বছর হবে। বসবাস করছে মোবারকগঞ্জ রেলস্টেশনের পূর্বপাশের বস্তির মর্জিনার ঝুপড়ি ঘরে। যশোরের বেল বস্তিতে কোনো পাগলি মায়ের গর্ভ জন্ম নেয়ার ক’দিন পরেই মর্জিনা তাকে নিয়ে আসেন। এরপর থেকে ভিক্ষুক মর্জিনাই তার মা।
আব্দুল্লাহর পালিত মা জোসেদা জানান,” পাগলী আমাদের এলাকায় বেড়াচ্ছিল, ওর পেটে বাচ্চা দেখে কেউ ওকে ঠাঁই দেয়নি। তখন আমি পাগলিকে আমার বাড়িতে নিয়ে এসেছি। পরে আমার বাড়িতেই আব্দুল্লাহর জন্ম হয়। তখন থেকেই আমি আব্দুল্লাহকে লালন পালন করছি। তবে ওর মা কোথায় হারিয়ে গেছে জানি না।“
আব্দুল্লাহর পালিত বাবা আবদুল মজিদ জানান, ছোট থেকে অনেক কষ্ট করে ওকে লালন পালন করেছি আমরা। এখন আমার চিন্তা আমি আর কতদিন বাঁচব। আমি মরে গেলে ছেলেটির কী হবে। এমন দিন গেছে আব্দুল্লাহকে নিয়ে আমরা না খেয়েও রাত কাটিয়েছি। আমি কাঠ কেটে খাই। ওর জামা কাপড় কিনে দেয়ার সামর্থ্য নেই, স্কুলে দেয়ার ক্ষমতা নেই আমাদের। ওর জন্য কেউ একটু সাহায্যও দেয় না। যদি সাহায্য করার মতো একটা লোক থাকত তাহলে হয়ত আমরা আব্দুল্লাহকে ভালোভাবে মানুষ করতে পারতাম।
ওই বাজারের চা দোকানি মুসলিম মিয়া জানান, আমাদের এখানে এক পাগলির গর্ভে জন্ম নেয় আব্দুল্লাহ। এরপর ওই পাগলি কোথাই চলে যায়, আর ফিরে আসেনি। তখন আমাদের গ্রামের আরেকজন ভিক্ষুক মহিলা তাকে লালন পালন করে।
ঝিনাইদহের মানবাধিকারকর্মী ও আমেনা খাতুন ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আমিনুর রহমান টুকু বলেন, ‘পাগলি মা হয়েছে, বাবা হয়নি কেউ’ এমন সংবাদ প্রায়ই পত্রিকার পাতায় অথবা টিভি চ্যনেলে সংবাদের রসদ যোগায়। কিন্তু তা কতটুকু নাড়া দিতে পারে আমাদের সভ্য বিবেককে? পাগলির সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের দায় কতটুকু গ্রহণ করে সভ্যতার মুখোশ পরা আমাদের এই ভদ্র সমাজ। জন্মের পরে একটি শিশু মায়ের কোলে বড় হয়। পরিবারের ভালোবাসা নিয়ে বড় হয়। কিন্তু আব্দুল্লাহরা জন্ম নেয় রাস্তায় পড়ে থাকা পাগলির গর্ভে। এদের নিয়ে সরকারের ভাবা উচিৎ। এসব পথশিশুদের জন্য প্রতিটি জেলায় আবাসনসহ বিশেষ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিৎ বলে মনে করেন এই মানবাধিকারকর্মী।